বদলে যাওয়ার গল্প
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে
আমি। পরিবারে বাবা-মা, আমি
ছাড়া আর কেউ নেই। ছোটবেলায়
পড়ালেখার প্রতি প্রচুর আগ্রহ থাকার
কারণে বাবা-মা দারিদ্র হওয়া
সত্ত্বেও বাঁধা দেয়নি। কিন্তু বাঁধ
সাধলো হাই স্কুলে উঠার পরে। কারন,
পড়ালেখার জন্য এখন অনেক টাকা খরচ
করতে হয়। টাকার কারণে আমার
পড়ালেখা বন্ধ হয়নি। তবে টাকা
উপার্জন করতে আমাকে অনেক কষ্ট
করতে হলো। এই কষ্টের কিছুটা লাঘব
ঘটলো অনার্স এ উঠার পর। তখন কিছু
প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচের
টাকা ম্যানেজ করতাম এবং বাবা-
মায়ের জন্যও সামান্য কিছু দিতাম।
ভাবলাম এখন আর কষ্ট করতে হবে না।
কিন্তু জীবনের শুরু যে এখনো বাকি তা
বুঝলাম B.C.S পরীক্ষার সময়। মাষ্টার্স
শেষ করার পর নিজেই B.C.S পরীক্ষার
জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।
পরীক্ষার তিন মাস আগে ঢাকায়
যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। ঢাকায়
আমার দূর সম্পর্কের এক চাচার কাছে
যাবো বলে স্থির করলাম। কিছু বই,
জামা-কাপড় আর নিজের খরচের জন্য
কিছু টাকা নিয়ে রওনা হলাম। অনেক
কষ্টের পর যখন ঢাকার মাটিতে পা
রাখলাম তখন থেকেই আমার বিপদ শুরু হয়।
প্রথমে পরি ছিনতাইকারীদের কবলে।
তারা আমার টাকা-পয়সা, জামা-
কাপড় সব নিয়ে যায়। শুধু বই-খাতা গুলো
রেখে যায়। তখন নিজেকে নিজে
সান্ত্বনা দিলাম এই বলে- "তারা তো
আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি
আমার কাছে রেখে গেছে"। তারপর
অনেক খোঁজাখুঁজির পর চাচার বাসা
খুঁজে নিলাম। বাসা খুঁজে পেলেও
চাচাকে বাসায় পেলাম না। বাসায়
থাকা লোকদের কাছ থেকে জানতে
পারলাম যে - চাচা তার কাজে
গিয়েছেন ফিরতে সন্ধ্যে হবে। তারা
আমাকে ভেতরে বসতে বলেছে কিন্তু
আমি ভেতরে যাই নি। বাইরে ছিলাম।
সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথেই চাচা
ফিরে এলো---
=> আসসালামুআলাইকুম।
→ওয়ালাইকুম......। আরে বাবা তুমি?
=> জি চাচা, কেমন আছেন?
→ হ ভালোই। তুমি কেমন আছো?
=> জি চাচা ভালো।
→ ভেতরে চলো।বাইরে কেন?
ভেতরে যাওয়ার পর একটা চেয়ার
টেনে বসতে বলে চাচা বিছানার উপর
বসলেন।
→ তো বাবাজি, বাড়ির সবার কি খবর?
=> জি চাচা সবাই ভালো আছে।
→ আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো?
=> না চাচা আসতে কোন সমস্যা হয় নি।
কিন্তু?
→ কী? কী হইছিল?
=> গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটার
পর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ি।
→ কী বলো?
=> না চাচা তারা আমার কোন ক্ষতি
করেনি। শুধু আমার টাকা-পয়সা আর
জামা-কাপড় নিয়ে গেছে।
→ আল্লাহ রক্ষা করেছে। সুস্থ মতো তো
ফিরে এসেছো।
=> ( মাথা নেড়ে তার কথাকে সমর্থন
করলাম)
→ তো বাবা, হঠাৎ ঢাকায় কেন?
=> চাচা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য
এসেছি।
→ কী পরীক্ষা?
=> B.C.S পরীক্ষা.
→ ও... তুমি তো গ্রামের মধ্যে শিক্ষিত
পোলা। আমরা তো জীবনে স্কুলের
ধারেও যাই নাই। B.C.S কি T.C.S নামও
শুনি নাই।
=> তো বাবা পরীক্ষা কবে?
→ তিনমাস পর।
=> ও.... তাহলেতো দেরি আছে।
তো বাবা থাকবা কার কাছে?
=> জি চাচা, শহরে তো আমার কেউ
নেই।তাই আপনার শরণাপন্ন হলাম।
কথাটা বলার সাথে সাথে চাচার
হাসি মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল।
আমি সহজেই অনুমান করতে পারলাম।
আমি আসাতে চাচার বিরাট সমস্যা
হচ্ছে, একটু পরেই তা টের পেলাম।
দুপুরে যাদের সাথে কথা বলেছিলাম
তারা সবাই ফিরে এসেছে।
রুমের ভেতর ডুকা মাত্রই চাচাকে
উদ্দ্যেশ্য করে বলল--
নিজের থাকার জায়গা নাই,আবার
আরেকজনরে জায়গা দিছে। এইখানে
দুইজনের জায়গা ওইবো না। থাকতে
ওইলে যেকোন একজনরেই থাইকতে
ওইবো। হয়তো তুমি থাকো আর না হয়
তোমার মেহমানরে রাখো।
চাচাকে দেখলাম, ওনাদের কোন
কথার প্রতিবাদ নি করেই নির্জীব
জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না।
তাই চাচাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে
বললাম--
=> চাচা আমি যাচ্ছি।
→ কোথায় যাবি?
=> আজকের রাতটা রাস্তার ধারে বা
মসজিদে কাটিয়ে দিবো। বাকি
দিনগুলো কিভাবে থাকবো তা
কালকে দিনের বেলায় ভাববো।
→ আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম
না।
=> যা করেছো সেটাই তো অনেক
বেশি।
→ তোর কাছে তো কোন টাকা-পয়সা ও
নেই।
কী খাবি??
আমি কিছু বলারর আগেই চাচা পকেট
থেকে কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে
বলল--
→ এই টাকা দিয়ে দোকান থেকে কিছু
খেয়ে নিস। দোয়া করি , যেখানে
থাকিস আল্লাহ যাতে তোকে ভালো
রাখে। আর কখনো কিছুর প্রয়োজন হলে
চলে আসিস।
এরপর চাচাকে সালাম দিয়ে তার কাছ
থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার একপাশ
ধরে হাঁটতে লাগলাম আর ভাবতে
লাগলাম এই অচেনা শহরে এখন কোথায়
যাবো আমি? কার কাছেই বা যাবো?
কেউ কি আমাকে তার আশ্রয়ে ঠাঁই
দিবে?
পেটে প্রছন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। রাস্তার
পাশে একটা টং দোকানে গিয়ে
বসলাম।
=> মামা একটা কলা আর একটা বন দিও।
→এই লও মামা।
এইগুলো খেয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে
নিলাম।তারপর দোকানদার মামার
খাবারের বিল পরিশোধ করে আবার
হাঁটতে শুরু করলাম।
ঢাকা শহরের কোনো কিছুই আমার
চেনা বা জানা নেই। কোথায় যাচ্ছি
কিছুই বলতে পারবো না। শুধু রাস্তার
পাশে দোকান-পাটের নাম এব্রয
জায়গার নাম পড়ছি।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা নির্জন
জায়গায় এসে পৌঁছালাম। রাস্তার
পাশেই একটা বিশাল মাঠ। মাঠের পরই
অনেক বড় একটা বাড়ি। আসলে এই শহরের
বাড়িগুলোই বিশাল বিশাল।
বাড়িতে যাওয়ার জন্য মাঠের পাশেই
একটা রাস্তা আছে।
রাস্তা ফ্লাইড লাইটের আলোয়
আলোকিত। জায়গাটা আমার অনেক
পছন্দ হয়েছে। আজকের রাতটা এখানে
দারুনভাবে কাটানো যাবে।
একটা ফ্লাইড লাইটে হেলান দিয়ে
বসলাম।শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। পড়ার কোন
ইচ্ছে না খাকা সত্ত্বেও ব্যাগটা
থেকে একটা বই বের করলাম। তারপর
বইটা খুলে একটু দেখলাম। এরপরে
ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে বইটা
পাশে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কখন যে
ঘুমের ঘোরে চলে গেলাম টেরই
পেলাম না।
সকাল বেলা এক ভদ্র সাহেবের
চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙল। তিনি খুব
চিৎকার করে বলতে লাগলেন--
এই ছেলে এখানে কি করো? ঘুমানোর
জন্য আর জায়গা পেলে না? যাও এখান
থেকে।
আমি ওনার কোন কথার কর্ণপাত না
করে সোজা ব্যাগটা কাঁদে নিয়ে আর
বইটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
পেছন থেকে ভদ্রলোক ডাক দিয়ে
বললেন---
→ এই ছেলে এইদিকে আসো?
আমি এগিয়ে গেলাম।
→ নাম ক?
=> শিশির।
→ নামতো সুন্দর আছে। দেখতে ও ভদ্র
ঘরের ছেলের মতো মনে হয়। তো আপনি
এখানে কেন ঘুমালেন? বাড়িতে কি
হয়েছে?
=> আমি শহরে নতুন। থাকার কোন
জায়গা নেই।
→ শহরে কি জন্য এসেছো?
=> পরীক্ষা দেওয়ার জন্য।
→B.C.S? ( সম্ভবত উনি আমার হাতের
বইটা দেখে বুঝতে পারেন)
=> জি।
আমার সাথে পেছনে পেছনে আসো।
আমি ওনাকে অনুকরণ করতে লাগলাম।
একটা রুমের ভেতর নিয়ে গিয়ে তিনি
আমাকে বসতে বললেন।
→ তোমাকে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে।
=> কেন স্যার?
→ তুমি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শহরে
এসেছো অথচ বলতেছো তোমার থাকার
জায়গা নেই।
=> ওনার সন্দেহ দূর করার জন্য খুব ছোট্ট
আকারে আমার সব ঘটনা খুলে বললাম।
→ সবই বুঝলাম।
তো এখন কী করবে?
=> প্রথমত থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
→ থাকার ব্যবস্থা??
ঢাকা শহরে বেকার ছেলেকে কেই
বাসা বাড়া দিবে।
(আমি চুপ করে বসে রইলাম)
→ আমি তোমার থাকা-খাওয়ার
ব্যবস্থা করতে পারি। তবে শর্ত আছে?
=> আপরার যেকোন শর্ত আমি মেনে
নিতে রাজি। বলুন কী শর্ত?
→ আমার বড় মেয়ে এবং ছোট ছেলেকে
প্রাইভেট পড়াবে। বিনিময় হিসেবে
তুমি থাকবে এবয় খাবে।
=> আমি রাজি।
→ খুব সাবধান। আমার ছেলে-মেয়ে
কিন্তু খিব রাগী।বিশেষ করে
মেয়েটা। এক মাসের বেশি কোন
টিচার-ই ওদেরকে পড়াতে পারেনি।
=> এটা নিয়ে আপনি কোন চিন্তা
করবেন না। আপনি শুধু আমার জন্য দোয়া
করবেন।
এই করিম, এইদিকে আয়।ও আমাদেন
টিচার। ওকে ওর রুমে নিয়ে যাবে আর
ওর আপ্যায়নে যাতে কোর কমতি না
থাকে।
জি হুজুর । সবকিছু ঠিক থাকবে।
এরপর থেকে শুরু হলো আমার শহুরে জীবন।
খুব ভালোভাবেই কেটে গেল দুইমাস।
এই বাসার সবাই আমার খুব আপন হয়ে
উঠলো। আর আমার দুই ছাত্র-ছাত্রী
তারা তো আমাকে ছাড়া কিছুই
বোঝে না।
পরীক্ষার সময়টা ঘনিয়ে এলো।
প্রিপারেশন খুব ভালোভাবেই নিলাম।
বাকি মাসটা নিজেকে আরো ভালো
করে প্রস্তুত করে নিলাম।
আজকে সকালে আমার পরীক্ষা।
বাড়িতে ফোন করে বাবা-মায়ের
দোয়া নিয়ে নিলাম। এরপর বাসার
সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে
পরীক্ষার হলে গেলাম।
পরীক্ষার সকল প্রশ্ন-ই আমার একেবারে
কমন পড়েছে। যার কারণে উত্তর দিতেও
কোস সমস্যা হয় নি।
রেজাল্টের দিন সর্বোচ্ছ নম্বরের চূড়ায়
আমার নাম। এই ফলাফল দেখে আমার
চোখে জল চলে আসে। এই চোখের জল
দুঃখের নয়,আনন্দের। আজ এখন এই মুহূর্ত
থেকে আমি একজন B.C.S ক্যাডার।
আসলে সাফল্য কোনো আকস্মিক
ব্যাপার না। এটি আমাদের মনোভাব ও
দৃষ্টিভঙ্গির ফল এবং এই মনোভাব
আমাদের-ই তৈরি করে নিতে হয়। আর
জীবনে সফল হতে হলে ব্যার্থতা বা
বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর এই
ব্যার্থতাই আমাদেরকে সাফল্যের
শিখরে পোঁছে দেয়। পাশাপাশি
আমাদের বিনম্রতা শেখায়। যে ব্যক্তি
ব্যার্থতাকে অতিক্রম করতে পারে
তার জীবনে সাফল্য অবধারিত।
সর্বশেষ শিব খেরার একটা কবিতা
দিয়েই শেষ করছি---
" পরাজয়কে মেনে নিলেই তুমি
পরাজিত
মনে যদি তোমার সাহস না থাকে,
তবে জেতার আশা করো না।
যদি মনে দ্বিধা থাকে তুমি পারবে
কি না,
তাহলে মনে রেখো, তুমি হেরেই গেছ।
হারবে ভাবলে,হার তোমার হবেই
কারণ,সাফল্য থাকে মনের
ইচ্ছাশক্তিতে,
মনের কাঠামোতে।
যদি ভাব অন্যদের তুলনায়
তোমার কাজের মান নিচু,
তাহলে তুমি নিচেই থাকবে।
যদি তুমি ওপরে উঠতে চাও
তাহলে নিজের মনে সংশয় রেখো না।
কারণ সংশয়। থাকলে প্রত্যাশা পূরণ হয়
না,
জীবন যুদ্ধে সব সময় বলবান ও দ্রুতগামীরা
জেতে না,যে আত্মবিশ্বাসে অটল,
সে আজ হোক, কাল হোক, জিতবেই।"
"সমাপ্ত"www.facebook.com/loveyou.rahim

Comments
Post a Comment